১৯ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হিমন্তের আদেশে অসমের পুলিশ হেফাজতের মধ্যেই নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২১, সোমবার
  • / 1

জয়নাল আবেদিন, জেহারুল ইসলাম,তপন বুরাগোহাই ও আখতার রেজা খান


নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
সরকার প্রধান হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কাছ থেকে এই ধরনের আশ্বাসবাণী পেলে সময় বিশেষে পুলিশ কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে– তা অনুমান করা কঠিন নয়। ৭ জুলাই– ২০২১ অসম হিউম্যান রাইটস কমিশন নির্দেশ দিয়েছে– রাজ্য সরকারকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এই তদন্ত কমিটি পুলিশের গুলিবর্ষণে যারা নিহত ও আহত হয়েছে সেই সম্পর্কে তদন্ত করে দেখবে। অসম মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নবকমল বরা মিডিয়াকে বলেছেন– সংবাদপত্রে যেসব খবর পাচ্ছেন তাতে দেখা যাচ্ছে যাদের পুলিশ গুলি করেছে তারা সকলেই পুলিশি হেফাজতে ছিল এবং তাদের হাতে ছিল হাতকড়া। কাজেই আমাদের জানা প্রয়োজন– কি ঘটেছিল, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন– তাঁরা নেশা দ্রব্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। আর এই অভিযোগে ১৮৯৭ জনকে পুলিশ গত দুই মাসে গ্রেফতার করেছে। আর অসম পুলিশ একটি আইনের বিরল ধারাকে প্রয়োগ করছে। তাতে নেশাখোররা যে সমস্ত ক্রাইম করে তাদেরকে বিনা বিচারে আটক রাখা যায়। কমপক্ষে ১৫ জনকে এই ধারায় বিগত কয়েক মাসের মধ্যে আটক করা হয়েছে। বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যে ৫ জনকে পুলিশ মে মাসের পর গুলি করেছে তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। তার মধ্যে একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পুলিশের হেফাজতে গুলিতে যে ৫ জন নিহত হয়েছে তাদের সম্পর্কে অবশ্য একটি বিচার-বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।
জয়নাল আবেদিন– ৪৭– নওগাঁও। তাকে গুলি করা হয় ১১ জুলাই।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডাকাতি ও সশস্ত্র ছিনতাই।
জয়নালের অবস্থা— নিহত।
পুলিশের বক্তব্য, ১১ জুলাই ভোর ২টোয় নওগাঁও পুলিশ জয়নালের বাড়িতে যায়। তাকে গ্রেফতার করার জন্য হানা দেয়। পুলিশের মতে– তারা নাকি খবর পেয়েছিল জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র গ্যাং ধিং এলাকায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছে। পুলিশ দাবি করছে– আমাদের জওয়ানরা ওই বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং জয়নালের নাম ধরে ডাকে। নওগাঁও-এর এসপি আনন্দ মিশ্র বলেন– আবেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গুলি চালাতে শুরু করে। আমরা এই ধরনের আক্রমণ আশা করিনি। কাজেই আমরা গুলি চালিয়ে প্রত্যুত্তর দিই। তাকে পায়ে গুলি করতে হয়। জয়নালকে আমরা নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেন– তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে।
আনন্দ মিশ্র মিডিয়াকে আরও বলেন– আবেদিন ছিল একজন স্থানীয় মাশলম্যান। তার বিরুদ্ধে আগেও ৪টি ঘটনায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল– সে একটি এনআরসি সেবা কেন্দ্রে ডাকাতি করেছে এবং অ্যাসিড দ্বারা আক্রমণ করেছে। আমরা তাকে গ্রেফতার করতে গিয়ে খবর পেলাম সে ধিং এলাকায় সশস্ত্র ডাকাতি করতে প্রস্তুতি নিয়েছে।
আবেদিন-এর পরিবারের বক্তব্য— আবেদিনের ভাই ইমবাদুল হক বলেন– পুলিশ আবেদিনকে বাড়িতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে-হিঁচড়ে বের করে। তারপর তাকে মারতে শুরু করে। এরপর পুলিশ তাকে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। আমরা জানি না কোথায় নিয়ে গেল এবং পুলিশ তাকে হত্যা করে।
আবেদিনের পরিবার আরও বলে– তারা তার ভাইয়ের খবর পায় ভোর ৬টা নাগাদ যখন গ্রাম প্রধানকে সংবাদ দেওয়া হয়। আমরা প্রতিবাদস্বরূপ আবেদিনের লাশ নিতে অস্বীকার করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের কোনও বিকল্প ছিল না। এটা ছিল ১০০ শতাংশ একটি ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনা। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
জেহারুল ইসলাম বয়স ৩০– বাকসা– ৯ জুলাই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ— নারী পাচার।
সে এখন নলবাড়ি জেলে রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য— পুলিশ বলছে জেহারুল দক্ষিণ শানমারা-মানকাছার এলাকার বাসিন্দা। সে একটি মহিলা ও তাঁর ৯ বছরের মেয়েকে কিডন্যাপ করে এবং তাদেরকে বিহারের কিষানগঞ্জ এলাকায় বিক্রি করে দেয়। পুলিশ বলে– জেহারুল হচ্ছে একজন নারীপাচারকারী। পরে পুলিশ ওই মহিলা ও তার কন্যাকে উদ্ধার করে। তারা জেহারুলকে গোয়ালপাড়ায় গ্রেফতার করে। আমরা এরপর তাকে যেখানে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল সেখানে নিয়ে যাই। কিন্তু সে পালাবার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়– সে পুলিশের একটি অস্ত্র ছিনতাই করে নেয়। পুলিশ বলে– তাই তারা জেহারুলের পায়ে গুলি করেছে। জেহারুলের বিরুদ্ধে পুলিশ বেশ কয়েকটি মামলা দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে নারীপাচার– কিডন্যাপিং– ধর্ষণ ইত্যাদি।
পরিবারের বক্তব্য— জেহারুলের ভাই জয়নাল বলে– পুলিশ ৭ জুলাই জেহারুল সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জেহারুল গুয়াহাটিতে মজুরের কাজ করত। আমরা পুলিশকে বলি– আমরা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করব এবং আমি পরেরদিন গুয়াহাটিতে যাই। জয়নালের মতে– জেহারুল পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয় এবং তারা গোয়ালপাড়া শহরে পুলিশের সঙ্গে দেখা করে। তারা তাকে হেফাজতে নেয়। পরেরদিন আমরা সংবাদ পাই– জেহারুলকে গুলি করা হয়েছে। জয়নাল দাবি করে– সে কোথায় কি অবস্থায় আছে তা তারা জানে না। আমরা শুনেছি– তাকে জেলে রাখা হয়েছে। আমার কাছে এমন অর্থ নেই যে আমি দূরবর্তী জেলে দিয়ে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না– জেহারুল যখন আত্মসমর্পণ করল তাহলে সে কেন পালাবার চেষ্টা করবে,
তপন বুরাগোহাই– বয়স ২৬– সাদিয়া। ৯ জুলাই পুলিশের হাতে গুলি বিদ্ধ।
অভিযোগ— সে আলফা সাহায্যকারী এবং তেল কোম্পানি ওএনজিসি-র একজন কর্মচারীকে কিডন্যাপিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
অবস্থা— বর্তমানে সে অসম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য— জুলাই মাসের ৯ তারিখে তপন বুরাগোহাইকে সাদিয়া পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত তেলঘরিয়া গ্রামে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ খবর পেয়েছিল– সে এপ্রিল মাসে ওএনজিসি-র কর্মচারীকে কিডন্যাপিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। সাদিয়ার পুলিশ সুপার সুমিত শর্মার বক্তব্য– বুরাগোহাই তাঁকে বলে অন্য একজন অভিযুক্ত যেখানে লুকিয়ে আছে– সেখানে তাদের নিয়ে যাবে। সে পুলিশ দলের সঙ্গে যখন যাচ্ছিল তখন পালাবার চেষ্টা করে। সে পুলিশের একটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর পুলিশ নিজেদের আত্মরক্ষায় গুলি চালায়। বুরাগোহাই-এর পায়ে গুলি করা হয়। শর্মা স্বীকার করেন– পুলিশ দলে ৭-৮ জন জওয়ান ছিল। তবে তারা ছড়িয়ে ছিল। যাতে আচমকা গুলির সম্মুখীন হতে না হয়।
পরিবারের বক্তব্য— বুরাগোহাই-এর একজন আত্মীয় বলেন– আমরা ওকে দেখতে পাই হাসপাতালে গিয়ে। প্রথমে তাকে স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাত ১২টা নাগাদ বুরাগোহাই-এর চোখে কাপড় বেঁধে দেওয়া হয় এবং তাকে একটি খোলা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সে পুলিশের কাছে মিনতি করতে থাকে– তাকে যেন বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ কোনও কথা না শুনে তাকে গুলি করে। তপন জানিয়েছে– আমি পালিয়ে যাব এর কোনও সুযোগই ছিল না। কারণ– সমস্ত পুলিশ জওয়ানই বন্দুক উঁচিয়ে ছিল। কেন তাকে পুলিশ এভাবে গুলি করল তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। বরাত জোরে সে বেঁচে আছে। কারণ– তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল।
পুলিশের গুলিতে হতাহতের মধ্যে আরও রয়েছে আকতার রাজা খান। বয়স ৪৮– ডিব্রুগড়ের বাসিন্দা। ৭ জুলাই পুলিশ তাকে গুলি করে। তাকে গুলি করা হয় গরু চুরির অভিযোগে।
পুলিশের মতে সে গ্রেফতার অবস্থায় পালাবার চেষ্টা করেছিল। সে পালিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল। তাকে রক্ষা করতেই পুলিশ গুলি করে। পুলিশের এসপি স্বীকার করেন– তার বিরুদ্ধে অতীতের তেমন কোনও মামলা নেই। কারণ– সে নিজে নাকি অপরাধ করত না।
আকতার রাজা খানের ছেলে জাহিদ বলে– তার বাবা মাড়োয়ারি পট্টিতে গরু নিয়ে যাচ্ছিল। সে এই গরুগুলি খরিদ করেছিল। আর খরিদের কাগজপত্রও তার কাছে ছিল। তাকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়। তিনি রাত ৮টার দিকে থানায় যান। যখন তার বাবা ঘরে ফিরল না তখন তার মা থানায় যায়। তাকে বলা হয় আকতার রাজা খানকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরেরদিন তারা জানতে পারে তার বাবাকে গুলি করা হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার ক্ষেত্রে সেই একই কাহিনি। তারও চোখ বেঁধে দেওয়া হয় এবং তাকে বলা হয় সে যেন পালাবার চেষ্টা করে– না হলে তাকে গুলি খেতে হবে। তার পিতা পুলিশের কাছে বিনতী করতে থাকে এবং পালাবার চেষ্টা করেনি। তার ফলেও তাকে গুলি খেতে হয়। আকতার রাজা খান-এর ছেলে জানায়– তার বাবা কোথায় আছে এখনও তারা জানে না।
একই ধরনের কাহিনি পুলিশের গুলিতে আহত বা নিহতের সকলেরই। কাউকে আবার পুলিশ হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে পালাতে বলে। না পালালে গুলি চালায়।
অসম পুলিশ বলছে– তাদের গুলি চালাবার পিছনে নাকি যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পুলিশ বলছে– গুলি চালানো শুরু করার পর থেকে অসমে অপরাধ নাকি অনেক কমে গেছে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা পুলিশের খুনির ভূমিকায় খুবই চিন্তিত।
শেষ কিস্তি…

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

হিমন্তের আদেশে অসমের পুলিশ হেফাজতের মধ্যেই নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে

আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২১, সোমবার


নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
সরকার প্রধান হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কাছ থেকে এই ধরনের আশ্বাসবাণী পেলে সময় বিশেষে পুলিশ কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে– তা অনুমান করা কঠিন নয়। ৭ জুলাই– ২০২১ অসম হিউম্যান রাইটস কমিশন নির্দেশ দিয়েছে– রাজ্য সরকারকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এই তদন্ত কমিটি পুলিশের গুলিবর্ষণে যারা নিহত ও আহত হয়েছে সেই সম্পর্কে তদন্ত করে দেখবে। অসম মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নবকমল বরা মিডিয়াকে বলেছেন– সংবাদপত্রে যেসব খবর পাচ্ছেন তাতে দেখা যাচ্ছে যাদের পুলিশ গুলি করেছে তারা সকলেই পুলিশি হেফাজতে ছিল এবং তাদের হাতে ছিল হাতকড়া। কাজেই আমাদের জানা প্রয়োজন– কি ঘটেছিল, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন– তাঁরা নেশা দ্রব্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। আর এই অভিযোগে ১৮৯৭ জনকে পুলিশ গত দুই মাসে গ্রেফতার করেছে। আর অসম পুলিশ একটি আইনের বিরল ধারাকে প্রয়োগ করছে। তাতে নেশাখোররা যে সমস্ত ক্রাইম করে তাদেরকে বিনা বিচারে আটক রাখা যায়। কমপক্ষে ১৫ জনকে এই ধারায় বিগত কয়েক মাসের মধ্যে আটক করা হয়েছে। বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যে ৫ জনকে পুলিশ মে মাসের পর গুলি করেছে তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। তার মধ্যে একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পুলিশের হেফাজতে গুলিতে যে ৫ জন নিহত হয়েছে তাদের সম্পর্কে অবশ্য একটি বিচার-বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।
জয়নাল আবেদিন– ৪৭– নওগাঁও। তাকে গুলি করা হয় ১১ জুলাই।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডাকাতি ও সশস্ত্র ছিনতাই।
জয়নালের অবস্থা— নিহত।
পুলিশের বক্তব্য, ১১ জুলাই ভোর ২টোয় নওগাঁও পুলিশ জয়নালের বাড়িতে যায়। তাকে গ্রেফতার করার জন্য হানা দেয়। পুলিশের মতে– তারা নাকি খবর পেয়েছিল জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র গ্যাং ধিং এলাকায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছে। পুলিশ দাবি করছে– আমাদের জওয়ানরা ওই বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং জয়নালের নাম ধরে ডাকে। নওগাঁও-এর এসপি আনন্দ মিশ্র বলেন– আবেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গুলি চালাতে শুরু করে। আমরা এই ধরনের আক্রমণ আশা করিনি। কাজেই আমরা গুলি চালিয়ে প্রত্যুত্তর দিই। তাকে পায়ে গুলি করতে হয়। জয়নালকে আমরা নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেন– তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে।
আনন্দ মিশ্র মিডিয়াকে আরও বলেন– আবেদিন ছিল একজন স্থানীয় মাশলম্যান। তার বিরুদ্ধে আগেও ৪টি ঘটনায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল– সে একটি এনআরসি সেবা কেন্দ্রে ডাকাতি করেছে এবং অ্যাসিড দ্বারা আক্রমণ করেছে। আমরা তাকে গ্রেফতার করতে গিয়ে খবর পেলাম সে ধিং এলাকায় সশস্ত্র ডাকাতি করতে প্রস্তুতি নিয়েছে।
আবেদিন-এর পরিবারের বক্তব্য— আবেদিনের ভাই ইমবাদুল হক বলেন– পুলিশ আবেদিনকে বাড়িতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে-হিঁচড়ে বের করে। তারপর তাকে মারতে শুরু করে। এরপর পুলিশ তাকে গাড়িতে করে নিয়ে যায়। আমরা জানি না কোথায় নিয়ে গেল এবং পুলিশ তাকে হত্যা করে।
আবেদিনের পরিবার আরও বলে– তারা তার ভাইয়ের খবর পায় ভোর ৬টা নাগাদ যখন গ্রাম প্রধানকে সংবাদ দেওয়া হয়। আমরা প্রতিবাদস্বরূপ আবেদিনের লাশ নিতে অস্বীকার করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের কোনও বিকল্প ছিল না। এটা ছিল ১০০ শতাংশ একটি ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনা। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
জেহারুল ইসলাম বয়স ৩০– বাকসা– ৯ জুলাই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ— নারী পাচার।
সে এখন নলবাড়ি জেলে রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য— পুলিশ বলছে জেহারুল দক্ষিণ শানমারা-মানকাছার এলাকার বাসিন্দা। সে একটি মহিলা ও তাঁর ৯ বছরের মেয়েকে কিডন্যাপ করে এবং তাদেরকে বিহারের কিষানগঞ্জ এলাকায় বিক্রি করে দেয়। পুলিশ বলে– জেহারুল হচ্ছে একজন নারীপাচারকারী। পরে পুলিশ ওই মহিলা ও তার কন্যাকে উদ্ধার করে। তারা জেহারুলকে গোয়ালপাড়ায় গ্রেফতার করে। আমরা এরপর তাকে যেখানে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল সেখানে নিয়ে যাই। কিন্তু সে পালাবার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়– সে পুলিশের একটি অস্ত্র ছিনতাই করে নেয়। পুলিশ বলে– তাই তারা জেহারুলের পায়ে গুলি করেছে। জেহারুলের বিরুদ্ধে পুলিশ বেশ কয়েকটি মামলা দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে নারীপাচার– কিডন্যাপিং– ধর্ষণ ইত্যাদি।
পরিবারের বক্তব্য— জেহারুলের ভাই জয়নাল বলে– পুলিশ ৭ জুলাই জেহারুল সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জেহারুল গুয়াহাটিতে মজুরের কাজ করত। আমরা পুলিশকে বলি– আমরা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করব এবং আমি পরেরদিন গুয়াহাটিতে যাই। জয়নালের মতে– জেহারুল পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয় এবং তারা গোয়ালপাড়া শহরে পুলিশের সঙ্গে দেখা করে। তারা তাকে হেফাজতে নেয়। পরেরদিন আমরা সংবাদ পাই– জেহারুলকে গুলি করা হয়েছে। জয়নাল দাবি করে– সে কোথায় কি অবস্থায় আছে তা তারা জানে না। আমরা শুনেছি– তাকে জেলে রাখা হয়েছে। আমার কাছে এমন অর্থ নেই যে আমি দূরবর্তী জেলে দিয়ে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না– জেহারুল যখন আত্মসমর্পণ করল তাহলে সে কেন পালাবার চেষ্টা করবে,
তপন বুরাগোহাই– বয়স ২৬– সাদিয়া। ৯ জুলাই পুলিশের হাতে গুলি বিদ্ধ।
অভিযোগ— সে আলফা সাহায্যকারী এবং তেল কোম্পানি ওএনজিসি-র একজন কর্মচারীকে কিডন্যাপিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
অবস্থা— বর্তমানে সে অসম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য— জুলাই মাসের ৯ তারিখে তপন বুরাগোহাইকে সাদিয়া পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত তেলঘরিয়া গ্রামে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ খবর পেয়েছিল– সে এপ্রিল মাসে ওএনজিসি-র কর্মচারীকে কিডন্যাপিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। সাদিয়ার পুলিশ সুপার সুমিত শর্মার বক্তব্য– বুরাগোহাই তাঁকে বলে অন্য একজন অভিযুক্ত যেখানে লুকিয়ে আছে– সেখানে তাদের নিয়ে যাবে। সে পুলিশ দলের সঙ্গে যখন যাচ্ছিল তখন পালাবার চেষ্টা করে। সে পুলিশের একটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর পুলিশ নিজেদের আত্মরক্ষায় গুলি চালায়। বুরাগোহাই-এর পায়ে গুলি করা হয়। শর্মা স্বীকার করেন– পুলিশ দলে ৭-৮ জন জওয়ান ছিল। তবে তারা ছড়িয়ে ছিল। যাতে আচমকা গুলির সম্মুখীন হতে না হয়।
পরিবারের বক্তব্য— বুরাগোহাই-এর একজন আত্মীয় বলেন– আমরা ওকে দেখতে পাই হাসপাতালে গিয়ে। প্রথমে তাকে স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাত ১২টা নাগাদ বুরাগোহাই-এর চোখে কাপড় বেঁধে দেওয়া হয় এবং তাকে একটি খোলা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সে পুলিশের কাছে মিনতি করতে থাকে– তাকে যেন বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশ কোনও কথা না শুনে তাকে গুলি করে। তপন জানিয়েছে– আমি পালিয়ে যাব এর কোনও সুযোগই ছিল না। কারণ– সমস্ত পুলিশ জওয়ানই বন্দুক উঁচিয়ে ছিল। কেন তাকে পুলিশ এভাবে গুলি করল তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। বরাত জোরে সে বেঁচে আছে। কারণ– তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল।
পুলিশের গুলিতে হতাহতের মধ্যে আরও রয়েছে আকতার রাজা খান। বয়স ৪৮– ডিব্রুগড়ের বাসিন্দা। ৭ জুলাই পুলিশ তাকে গুলি করে। তাকে গুলি করা হয় গরু চুরির অভিযোগে।
পুলিশের মতে সে গ্রেফতার অবস্থায় পালাবার চেষ্টা করেছিল। সে পালিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল। তাকে রক্ষা করতেই পুলিশ গুলি করে। পুলিশের এসপি স্বীকার করেন– তার বিরুদ্ধে অতীতের তেমন কোনও মামলা নেই। কারণ– সে নিজে নাকি অপরাধ করত না।
আকতার রাজা খানের ছেলে জাহিদ বলে– তার বাবা মাড়োয়ারি পট্টিতে গরু নিয়ে যাচ্ছিল। সে এই গরুগুলি খরিদ করেছিল। আর খরিদের কাগজপত্রও তার কাছে ছিল। তাকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়। তিনি রাত ৮টার দিকে থানায় যান। যখন তার বাবা ঘরে ফিরল না তখন তার মা থানায় যায়। তাকে বলা হয় আকতার রাজা খানকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরেরদিন তারা জানতে পারে তার বাবাকে গুলি করা হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার ক্ষেত্রে সেই একই কাহিনি। তারও চোখ বেঁধে দেওয়া হয় এবং তাকে বলা হয় সে যেন পালাবার চেষ্টা করে– না হলে তাকে গুলি খেতে হবে। তার পিতা পুলিশের কাছে বিনতী করতে থাকে এবং পালাবার চেষ্টা করেনি। তার ফলেও তাকে গুলি খেতে হয়। আকতার রাজা খান-এর ছেলে জানায়– তার বাবা কোথায় আছে এখনও তারা জানে না।
একই ধরনের কাহিনি পুলিশের গুলিতে আহত বা নিহতের সকলেরই। কাউকে আবার পুলিশ হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে পালাতে বলে। না পালালে গুলি চালায়।
অসম পুলিশ বলছে– তাদের গুলি চালাবার পিছনে নাকি যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পুলিশ বলছে– গুলি চালানো শুরু করার পর থেকে অসমে অপরাধ নাকি অনেক কমে গেছে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা পুলিশের খুনির ভূমিকায় খুবই চিন্তিত।
শেষ কিস্তি…