বাংলাকে কতবার ভঙ্গ করবেন শুভেন্দুরা!

- আপডেট : ২২ জুন ২০২১, মঙ্গলবার
- / 1
আহমদ হাসান ইমরান
বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী পালন করলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’। তাঁর বক্তব্য– ‘২০ জুন যদি বাংলার ৫৪ জন হিন্দু বিধায়ক অবিভক্ত বাংলাকে খণ্ড করার পক্ষে ভোট না দিতেন, তাহলে আজ পশ্চিমবঙ্গকে ঢাকার অধীনে থাকতে হত। থাকতে হত মুসলমান আধিপত্যের অধীনে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং সাভারকার প্রমুখ হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় বাংলার অ্যাসেম্বলিতে যে ভোট হয়– তাতে কংগ্রেসেরসহ ৫৪ জন হিন্দু বিধায়ক বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুও ছিলেন। আর তা না হলে আজ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদেরকে মুসলিম আধিপত্যের মধ্যে থাকতে হত।’
শুভেন্দু ঠিক বলেছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সাভারকারের মতো শুভেন্দু নিজেও যে প্রবল মুসলিম বিদ্বেষ পোষণ করেন– তা বেশ বোঝা যায়। প্রথমে তিনি ধরে ছিলেন পাকিস্তানকে। নির্বাচনে বারবার বলেছেন মেদিনীপুর ও বাংলার মুসলিমরা নাকি পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু শুভেন্দুর এই বক্তব্য বাংলার মানুষ মোটেই বিশ্বাস করেনি। তাই এবার ঝানু রাজনীতিবিদ শুভেন্দু ঘরের পাশের ঢাকা ও বাংলাদেশকে নিয়ে পড়েছেন। আর ১৯৪৭-এ দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ হওয়ার ফলে তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন এবং ভোটাভুটির দিন ২০ জুনকে তিনি ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে পালনের ডাক দিয়েছেন। আর নিজেও বিজেপি দফতরে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করে কয়েকজন বিজেপি বিধায়ককে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বিধানসভায়। তবে ঢুকতে পারেননি। বিধানসভার ৪ নম্বর গেটেই তিনি ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করে ফেলেন। তাঁর দাবি– প্রত্যেক দলকেই এই ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করতে হবে। কারণ– এই দিনটিতেই নাকি পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তান হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে।
এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী ইতিহাস ও ঐতিহাসিক তথ্যকে একটু গুলিয়ে ফেলেছেন। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ ইতিহাসে শুভেন্দুবাবুর বিশেষ জ্ঞানগম্মি রয়েছে বলে কখনও শোনা যায়নি। এখন অবশ্য বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা আমদানির লক্ষ্যে তিনি গেরুয়া চশমা দিয়ে ইতিহাস অধ্যয়ন করছেন। ভালো কথা। তবে তাঁর ইতিহাস-জ্ঞানে বড় ধরনের খামতি রয়েছে।
তবে সেই সময় মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মহাত্মা গান্ধির আপত্তিকে নস্যাৎ করে দু-পক্ষেরই বড় বড় নেতারা ভারত ভাগ করার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতা করে বসেছিলেন। অবিভক্ত বাংলা ছিল ব্যতিক্রম। এখানে তখন শুরু হয়েছে ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’ বলে একটি মুভমেন্ট। এর উদ্যোক্তা ছিলেন বাংলার প্রিমিয়ার হোসেন শহিদ সোহওয়ার্দী এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসু। আরও বেশ কিছু বড় বড় নেতারা ছিলেন এই ইউনাইটেড বেঙ্গল-এর পক্ষে বা বিপক্ষে। ইউনাইটেড বেঙ্গল-এর উদ্দেশ্য ছিল– বাংলা অবিভক্ত থাকবে। বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগুরু– সংখ্যালঘু না দেখে সমানভাবে ক্ষমতা ভাগ করে নেবেন। অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমান এবং স্বরাষ্টÉমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু। চাকরি-বাকরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেও কীভাবে ক্ষমতা ভাগ হবে তার একটি লিখিত খসড়া পেশ করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং কংগ্রেসের বেশ কিছু নেতা বাংলা ভাগ করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। তাঁরা ছিলেন ইউনাইটেড বেঙ্গল বা যুক্ত বাংলার ঘোরতর বিরোধী। তৎকালীন হিন্দু সংবাদমাধ্যম জোরালো ভাবে ইউনাইটেড বেঙ্গল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন। ইংরেজি অমৃতবাজার পত্রিকা এবং বাংলা আনন্দবাজার বাংলা ভাগ করার পক্ষে পাঠকদের মধ্যে দু-দুটি জরিপও করে ফেলে। অমৃতবাজার ও আনন্দবাজারের পাঠকদের ৯০ শতাংশেরও বেশি বাংলার ভাগ করার পক্ষে মত ব্যক্ত করে। আর বাংলার অ্যাসেম্বলিতে ২০ জুন যে ভোট হয় তাতে ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল পরিকল্পনা’ খারিজ করে দিয়ে বাংলা ভাগের পক্ষে মত দেওয়া হয়। আর তার ফলেই হয় ১৯৪৭ সালের ‘দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ’।
শুভেন্দু অধিকারী যে মিথ্যাচারটি করছেন তা হল, বাংলা অখণ্ড থাকলে তা পাকিস্তানে যেত। কথাটি ডাহা মিথ্যা। বরং অবিভক্ত বাংলা হত হিন্দু-মুসলিমের সম্মেলনে একটি স্বাধীন রাষ্টÉ। এমনকী মুহাম্মদ আলি জিন্নাও এই প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। গান্ধিজিও নিমরাজি ছিলেন। কিন্তু পরে তাবড় তাবড় কংগ্রেস নেতারা গান্ধিজিকে চাপ দিয়ে বাংলা ভাগে রাজি করান। আর তার ফলে দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলা। তাই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলা ভাগ করলে তিনি লিখেছিলেন—‘বাংলার মাটি বাংলার জল/বাংলার বায়ু বাংলার ফল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক/পুণ্য হউক হে ভগবান… বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন/বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন/এক হউক এক হউক/এক হউক হে ভগবান।’
হায়, ১৯৪৭ সালে ‘এক হউক’ বার্তা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন না।
যদি বাংলা খণ্ড না হত, তাহলে আজ বাংলার অধিবাসীরা যে কি বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হতেন– তা খানিকটা অনুমান করা যায়। আর ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গকেই শুভেন্দুরা সেলিব্রেট করে তৃপ্তি পেতে চাইছেন। এ দিকে আবার বিজেপি উত্তরবাংলা নিয়ে তৃতীয় বঙ্গভঙ্গ-এরও ডাক দিয়ে বসেছে। তাই হয়তো আলেকজান্ডার বলেছিলেন– ‘সত্য সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ!’