২৫ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১০ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার মর্যাদা

Juifa Parveen
  • আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, শুক্রবার
  • / 1

মাওলানা মিরাজ রহমানঃ ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এই স্বীকৃতি আদায়ের পিছনে রয়েছে বাঙালি মুসলিম ভাষা শহীদদের কুরবানি। ইসলাম সব ভাষাকেই মর্যাদা দেয়। তাই ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসে কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার মর্যাদাকে এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।

⇒ ভাষা আল্লাহ্তায়ালার অনন্য একটি দান। আল্লাহ্তায়ালার অসংখ্য-অগণিত দান আর নিয়ামতে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন-সংসার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জীবনের শুরু থেকে বিদায় পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ্ মহানের দান-নিয়ামতের মুখাপেক্ষী আমরা। মহান আল্লাহর নিয়ামতভোগী মাখলুক আমরা মানুষ। অন্যন্য একটি নিয়ামত। মানবজাতিকে প্রদান করা বিশেষ নিয়ামত। ভাষা জীবনের এমন একটি অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়- যা ছাড়া সুস্থ ও সম্পূর্ণ জীবন কল্পনা করা যায় না। ভাষার ব্যবহার, ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম।

⇒ পবিত্র কুরআনের সূরা আর-রহমানের প্রথমদিকে আল্লাহ্তায়ালা বলেছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছি বয়ান বা উপস্থাপনজ্ঞান’। আলোচ্য আয়াতের মাঝে মানুষকে উপস্থাপনজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করার কথা বলার মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

⇒ আল্লাহ্তায়ালা মানবকূলকে যত নিয়ামত দিয়েছেন তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। মানুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারে। মনের মণিকোঠায় লুকানো সুখানুভূতি-দুঃখানুভূতি নিমিষেই প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছে।  আল্লাহ্তায়ালা মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন, যা অন্য কোনও প্রাণীকে দেননি। পশু-প্রাণী কখনও তাদের মনের বেদনা কারও’র কাছে বলতে পারে না- আনন্দ-উল্লাস অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে না। কিন্তু ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষ তাঁদের সব অনুভুতি অন্যের সঙ্গে আদান-প্রদান করতে পারে। এ এক অপূর্ব নিয়ামত।

⇒ আল্লাহ্তায়ালার অসংখ্য কুদরত ও নিদর্শন আমাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে। এইসব নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে কথা বলা বা ভাষার নিদর্শনটিই আমরা অনুভব করি এবং ব্যবহার করি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হল- আসমান জমিন সৃষ্টি, তোমাদের বিভিন্ন রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা’। (সূরা রূম, আয়াত: ২২)

⇒ আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে আলাদা আলাদা ভাষা দিয়েছেন। সব ভাষাই আল্লাহ্র সৃষ্টি, আল্লাহর দান। সব ভাষাই আল্লাহর কাছে সমান। আল্লাহ্তায়ালা হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টির পর তাঁকে সব ধরনের ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।

ইসলামের আলোকে ভাষার মর্যাদা 

⇒ আল্লাহ্তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকুলকে। তাঁর কোনও নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভুক্ত। মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষা। ভাষাকে আল্লাহ্তাআলা তাঁর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন।

⇒ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তার এক নিদর্শন হল, তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার ভিন্নতা।’ (সূরা রূম, আয়াত : ২২)  ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাক্হীন নিথর কোনও ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ- তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ্তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামত। সব প্রাণীরই স্ব-স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বাচ্ছন্দ্য, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনও প্রাণীর নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মহাত্ম্য। প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম তাঁকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।

⇒ পবিত্র কুরআনে বলা  হয়েছে,  ‘হযরত আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন।’ (সূরা বাকারাহ্, আয়াত : ৩১)

⇒ কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘মানবজাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বর্ণনা করার জ্ঞান দিয়েছেন।’ (সূরা আর রহমান, আয়াত : ৪)

⇒ মহান স্রষ্টা মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবীদের মাতৃভাষায় করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে।’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত: ৪ )

⇒ প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হল, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সঙ্গে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য আকুল প্রয়াস চালানো। তবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে- স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করায় আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হব।

♦ বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব

⇒ ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন আরবের অধিবাসী, তাই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়।

⇒ পবিত্র কুরআনে বাণীসমূহ ও রাসূলের হাদিসকে তাই বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং এটাই সময়ের অনিবার্য দাবি। কারণ আমাদের ভাষা আরবী নয়। পবিত্র কুরআন বোঝার স্বার্থে মুসলমানদের আরবি ভাষা জানা আবশ্যক হলেও আরবীভাষী না হওয়ার কারণে সকলের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।

⇒ তাই পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামি ফিকহ, তাফসির, বিধি-বিধান ও ইসলামি সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এদেশের মুসলমানদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এই দেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মপ্রাণ কিন্তু শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের সঠিক চেতনা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভাবে তাঁদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন না।

⇒ একসময় ফারসি ভাষাকে অমুসলিমদের ভাষা মনে করা হত। রুমি, জামি, শেখ শাদিরা সেই ভাষায় অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য রচনা করে ফারসি ভাষাকে জয় করে ফেলেন। এতে ইসলামের বিশাল উপকার হয়। আল্লামা ইকবাল উর্দু ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা ইসলামি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষায়ও আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই তাঁদের কবিতা ও সাহিত্যে ইসলামকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর। বাংলা ভাষায় ইসলামের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনও বই বা রচনা না থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পারে না। বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করা এখন যুগের একান্ত চাহিদা।

♦  ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মর্যাদা

⇒ ইসলামে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। শহীদ দুই প্রকার। এক, ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন যাঁরা অথবা যাঁদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। দুই, কোনও মহামারিতে, পানিতে ডুবে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে অথবা কোনও ভবন বা স্থাপনা ধসে তার নিচে চাপা পড়ে যদি কোনও মুসলমান প্রাণ হারায়- ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ বলে বিবেচিত হবেন তাঁরা। এমনিভাবে সন্তান প্রসবের সময় কোনও স্ত্রীলোক যদি মৃত্যুবরণ করেন সেও শহীদ বলে গণ্য হবেন।

⇒ অন্যদিকে পড়শি দেশ বাংলাদেশের মুসলমানগণ ভাষার জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতেরা মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে বাংলা ভাষাকে ধন্য করেছেন। অন্যের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তাঁরা। ইসলামের আলোচনা অনুযায়ী ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা শহীদ। স্বাধীনতার জন্য এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ দেশে দেশে লড়াই করে কিন্তু মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশীরাই তৈরি করেছে।

⇒ শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন আলোচনা এসেছে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,  ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুণাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ কেননা, শাহাদাত তথা অন্যান্য নেক আমল দ্বারা কেবল আল্লাহর হক মাফ হয়। কিন্তু ঋণ তথা বান্দাহর  হক  আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত হকদার ব্যক্তি ক্ষমা না করেন। জামে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে,  ‘শহীদকে মহান আল্লাহ্তায়ালা প্রথমেই ক্ষমা করে দেন। এরপর জান্নাতে তার আবাসস্থল দেখানো হয়, কবরের ভয়াবহ আযাব থেকে হেফাজত রাখবেন।

 

⇒ কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদে থাকবে এবং তার মাথায় বিশেষ মুকুট পরিধান করানো হবে।’
মহান আল্লাহ্তায়ালা শহীদদের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন,  ‘তোমরা তাদের (শহীদদের) মৃত বলো না। তারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে রিযিকপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং ভাষা শহীদ কিংবা যে-কোনও ধরনের শহীদ হোক না কেন, আল্লাহ্ মহানের কাছে রয়েছে তার জন্য আলাদা মর্যাদা এবং ইসলাম তাকে প্রদান করেছে বিশেষ গুরুত্ব। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে ভাষা শহীদদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমিন!

Tag :

রিপোর্টার

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার মর্যাদা

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, শুক্রবার

মাওলানা মিরাজ রহমানঃ ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এই স্বীকৃতি আদায়ের পিছনে রয়েছে বাঙালি মুসলিম ভাষা শহীদদের কুরবানি। ইসলাম সব ভাষাকেই মর্যাদা দেয়। তাই ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসে কুরআনের আলোকে মাতৃভাষার মর্যাদাকে এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।

⇒ ভাষা আল্লাহ্তায়ালার অনন্য একটি দান। আল্লাহ্তায়ালার অসংখ্য-অগণিত দান আর নিয়ামতে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন-সংসার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জীবনের শুরু থেকে বিদায় পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ্ মহানের দান-নিয়ামতের মুখাপেক্ষী আমরা। মহান আল্লাহর নিয়ামতভোগী মাখলুক আমরা মানুষ। অন্যন্য একটি নিয়ামত। মানবজাতিকে প্রদান করা বিশেষ নিয়ামত। ভাষা জীবনের এমন একটি অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়- যা ছাড়া সুস্থ ও সম্পূর্ণ জীবন কল্পনা করা যায় না। ভাষার ব্যবহার, ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম।

⇒ পবিত্র কুরআনের সূরা আর-রহমানের প্রথমদিকে আল্লাহ্তায়ালা বলেছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছি বয়ান বা উপস্থাপনজ্ঞান’। আলোচ্য আয়াতের মাঝে মানুষকে উপস্থাপনজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করার কথা বলার মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

⇒ আল্লাহ্তায়ালা মানবকূলকে যত নিয়ামত দিয়েছেন তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। মানুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারে। মনের মণিকোঠায় লুকানো সুখানুভূতি-দুঃখানুভূতি নিমিষেই প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছে।  আল্লাহ্তায়ালা মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন, যা অন্য কোনও প্রাণীকে দেননি। পশু-প্রাণী কখনও তাদের মনের বেদনা কারও’র কাছে বলতে পারে না- আনন্দ-উল্লাস অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে না। কিন্তু ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষ তাঁদের সব অনুভুতি অন্যের সঙ্গে আদান-প্রদান করতে পারে। এ এক অপূর্ব নিয়ামত।

⇒ আল্লাহ্তায়ালার অসংখ্য কুদরত ও নিদর্শন আমাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে। এইসব নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে কথা বলা বা ভাষার নিদর্শনটিই আমরা অনুভব করি এবং ব্যবহার করি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্তায়ালা বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হল- আসমান জমিন সৃষ্টি, তোমাদের বিভিন্ন রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা’। (সূরা রূম, আয়াত: ২২)

⇒ আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে আলাদা আলাদা ভাষা দিয়েছেন। সব ভাষাই আল্লাহ্র সৃষ্টি, আল্লাহর দান। সব ভাষাই আল্লাহর কাছে সমান। আল্লাহ্তায়ালা হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টির পর তাঁকে সব ধরনের ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন।

ইসলামের আলোকে ভাষার মর্যাদা 

⇒ আল্লাহ্তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকুলকে। তাঁর কোনও নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়। তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভুক্ত। মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষা। ভাষাকে আল্লাহ্তাআলা তাঁর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন।

⇒ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তার এক নিদর্শন হল, তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার ভিন্নতা।’ (সূরা রূম, আয়াত : ২২)  ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাক্হীন নিথর কোনও ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ- তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ্তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামত। সব প্রাণীরই স্ব-স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বাচ্ছন্দ্য, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনও প্রাণীর নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মহাত্ম্য। প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম তাঁকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।

⇒ পবিত্র কুরআনে বলা  হয়েছে,  ‘হযরত আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন।’ (সূরা বাকারাহ্, আয়াত : ৩১)

⇒ কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘মানবজাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বর্ণনা করার জ্ঞান দিয়েছেন।’ (সূরা আর রহমান, আয়াত : ৪)

⇒ মহান স্রষ্টা মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবীদের মাতৃভাষায় করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে।’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত: ৪ )

⇒ প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হল, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সঙ্গে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য আকুল প্রয়াস চালানো। তবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে- স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করায় আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হব।

♦ বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব

⇒ ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন আরবের অধিবাসী, তাই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়।

⇒ পবিত্র কুরআনে বাণীসমূহ ও রাসূলের হাদিসকে তাই বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং এটাই সময়ের অনিবার্য দাবি। কারণ আমাদের ভাষা আরবী নয়। পবিত্র কুরআন বোঝার স্বার্থে মুসলমানদের আরবি ভাষা জানা আবশ্যক হলেও আরবীভাষী না হওয়ার কারণে সকলের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।

⇒ তাই পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামি ফিকহ, তাফসির, বিধি-বিধান ও ইসলামি সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এদেশের মুসলমানদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এই দেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মপ্রাণ কিন্তু শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের সঠিক চেতনা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভাবে তাঁদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন না।

⇒ একসময় ফারসি ভাষাকে অমুসলিমদের ভাষা মনে করা হত। রুমি, জামি, শেখ শাদিরা সেই ভাষায় অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য রচনা করে ফারসি ভাষাকে জয় করে ফেলেন। এতে ইসলামের বিশাল উপকার হয়। আল্লামা ইকবাল উর্দু ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা ইসলামি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষায়ও আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই তাঁদের কবিতা ও সাহিত্যে ইসলামকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর। বাংলা ভাষায় ইসলামের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনও বই বা রচনা না থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পারে না। বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করা এখন যুগের একান্ত চাহিদা।

♦  ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মর্যাদা

⇒ ইসলামে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। শহীদ দুই প্রকার। এক, ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন যাঁরা অথবা যাঁদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। দুই, কোনও মহামারিতে, পানিতে ডুবে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে অথবা কোনও ভবন বা স্থাপনা ধসে তার নিচে চাপা পড়ে যদি কোনও মুসলমান প্রাণ হারায়- ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ বলে বিবেচিত হবেন তাঁরা। এমনিভাবে সন্তান প্রসবের সময় কোনও স্ত্রীলোক যদি মৃত্যুবরণ করেন সেও শহীদ বলে গণ্য হবেন।

⇒ অন্যদিকে পড়শি দেশ বাংলাদেশের মুসলমানগণ ভাষার জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতেরা মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে বাংলা ভাষাকে ধন্য করেছেন। অন্যের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তাঁরা। ইসলামের আলোচনা অনুযায়ী ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা শহীদ। স্বাধীনতার জন্য এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ দেশে দেশে লড়াই করে কিন্তু মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশীরাই তৈরি করেছে।

⇒ শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন আলোচনা এসেছে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,  ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুণাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ কেননা, শাহাদাত তথা অন্যান্য নেক আমল দ্বারা কেবল আল্লাহর হক মাফ হয়। কিন্তু ঋণ তথা বান্দাহর  হক  আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত হকদার ব্যক্তি ক্ষমা না করেন। জামে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে,  ‘শহীদকে মহান আল্লাহ্তায়ালা প্রথমেই ক্ষমা করে দেন। এরপর জান্নাতে তার আবাসস্থল দেখানো হয়, কবরের ভয়াবহ আযাব থেকে হেফাজত রাখবেন।

 

⇒ কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদে থাকবে এবং তার মাথায় বিশেষ মুকুট পরিধান করানো হবে।’
মহান আল্লাহ্তায়ালা শহীদদের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন,  ‘তোমরা তাদের (শহীদদের) মৃত বলো না। তারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে রিযিকপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং ভাষা শহীদ কিংবা যে-কোনও ধরনের শহীদ হোক না কেন, আল্লাহ্ মহানের কাছে রয়েছে তার জন্য আলাদা মর্যাদা এবং ইসলাম তাকে প্রদান করেছে বিশেষ গুরুত্ব। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে ভাষা শহীদদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমিন!